অবহেলার কষ্টের গল্প | স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

 ভালোবাসার মানুষের অবহেলা

ভালোবাসার মানুষের অবহেলা

আমার স্ত্রী অনন্যা খুবই সাধাসিধে, সাধারণ একটা মেয়ে। এমন খুব কম মেয়ে আছে যার মাসে লাখটাকার উপরে আয় কিন্তু আমার স্ত্রীর মতো সাধাসিধে৷ আমার স্ত্রী একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স, সাথে এমফিল। ওখানে চাকুরীও পেয়েছিল। কিন্তু অনন্যার বাবা ওকে ব্ল্যাকমেইল করে দেশে এনে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। 


আমাদের নিজেদের হাসপাতাল রয়েছে। নামকরা প্রাইভেট হসপিটাল। আমি সেই হাসপাতালের পরিচালক। আগে বাবা ছিল। কিন্তু বিদেশ থেকে এফসিপিএস করে আসার পর বাবা আমাকে পরিচালক বানিয়ে দিল। সাথে আমি হার্টসার্জনও। আমার খুব ইচ্ছা ছিল ডাক্তার বিয়ে করার। কিন্তু আপু অনন্যাকে পছন্দ করে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল।


গুলশানের ২৭০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে আমাদের সুখের সংসার ছিল। আমরা সুখীই ছিলাম। অনন্যার দুই দুইবার মিসক্যারেজ হওয়ার পরও আমরা সুখী ছিলাম। ডাক্তার বলেছিল টাইম লাগবে আরো। তবে অনন্যা কন্সিভ করতে পারবে। কিন্তু হঠাৎই আমার পুরোনো ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমাদের হসপিটালে নতুন জয়েন করা গাইনি ডাক্তার হিয়াকে আমার দারুন লাগা শুরু করল। কেন জানি মনে হতো হিয়াও আমাকে চাইতো।


শুরু হলো আমাদের সম্পর্ক। প্রথমে চুপিচুপি হলেও পরে প্রকাশ্যেই আমরা আমাদের সম্পর্ক চালিয়ে যেতে লাগলাম। কখনো ভাবিনি একবারের জন্য এসব শুনলে অনন্যা কতোটা কষ্ট পাবে। আমার বোন কতোটা কষ্ট পাবে। আস্তে আস্তে সবটা সবাই জানতে শুরু করল। আপু ইংল্যান্ডে থাকতো স্বপরিবারে। আপু সবটা জানতে পেরে আমাকে ফোনে অনেক কথা বলেছিল। রাগের চোটে আপুকে অনেক আজেবাজে কথা শুনিয়ে দিয়ে মুখের উপর ফোন কেটে দিয়েছিলাম৷ ওটা ছিল আমার সাথে আমার আদরের বড় বোনের শেষ কথা। ও আর এদেশে আসেনি। আমাকে কখনো কল ও করেনি। আমার খারাপ লাগেনি। আসলে খারাপ লাগার সময়টুকু পাইনি। ব্যস্ত ছিলাম হিয়াকে নিয়ে।


.


আমার হার্ট স্পেশালিষ্ট বাবাও আমাকে বুঝিয়েছিল অনেকবার। বার বার বলেছিল আমার মতো ভুল করিসনা। আমার বাবা ২টা বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী আমার মা। সেই ঘরে ছিলাম আমি আর আমার বড় বোন। আমরা ছোট থাকতে বাবা এক নার্সের প্রেমে পড়েন। পরে ওই মহিলা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে বাবা বাধ্য হন উনাকে বিয়ে করতে। মা অনেক কষ্ট পান। আমাকে আর আমার আমার বড় বোনকে নিয়ে আমার মা এই ২৭০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে চলে আসেন। আপু যখন এমবিবিএস থার্ড ইয়ারে, আর আমি মাত্র ভর্তিযুদ্ধে, মা তখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় হার্ট অ্যাটাকে।


বাবা আমাকে বারবার বলেছিল,

- "মানুষের অভিশাপ বড় জিনিস, জীবনে সব থাকবে, টাকা পয়সা খ্যাতি কিন্তু সুখ থাকবে না। অনন্যা যদি সব জানতে পারে খুব কষ্ট পাবে, ওকে কষ্ট দিস না।"


কিন্তু আমি বাবার কথা কানে তুলিনি। আমি জানি না তখন আমার ঠিক কি হয়েছিল। শুধু জানি আমি তখন শুধু হিয়াকে চাইতাম।


অনন্যার কখনো কোনো চাহিদা ছিল না। ছিল এক বস্তা অভিমান। এই মেয়ের অভিমান ছিল প্রচন্ড। হাসবে খেলবে কথা বলবে। কিন্তু বোঝা দ্বায় মনের মধ্যে অভিমান পাথার চাপা দেওয়া। অনন্যা সবই জানতে পেরেছিল। আমাকে আর হিয়াকে নাকি অনেকবার একসাথে অনন্যা দেখেওছিল। কিন্তু কখনো কিছু বলেনি। আমি বাসায় খুব একটা যেতাম না। অনেকদিন পর পর যেতাম। গেলেও অনন্যার সাথে কথা বলতাম না। খেতাম না। অনন্যা কিছু বললে ওকে বকাঝকা করতাম। 


.


একদিন হাসপাতাল থেকে হিয়ার বাসায় গিয়ে দেখি ও কান্না করছে৷ জিজ্ঞেস করতেই তুমুল ঝগড়া। পরে জানতে পারলাম অনন্যা বাসায় এসে ওকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়ে গেছে। একে তো সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত, তার উপর হিয়ার সাথে ঝগড়া। সোজা গাড়ী নিয়ে বাসায় গেলাম, গিয়েই কথা নেই বার্তা নেই অনন্যাকে মারা শুরু করলাম। এলোপাথাড়ি মার যাকে বলে। অনন্যা মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পর ওকে জুতা পায়েই এলোপাথাড়ি লাথি মারতে লাগলাম। তারপর ওই বাসা থেকে চলে আসলাম। হিয়ার বাসায় থাকা শুরু করলাম। 


.


একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাগজ নিতে দুইমাস পর যখন নিজের বাসায় গেলাম তখন অনন্যাকে দেখে আমার প্রচন্ড মায়া কাজ করল। কি হাল হয়েছে মেয়েটার শরীরের। এই দুইমাসে অনন্যার সাথে আমার একবারের জন্য দেখা হয়নি কথা হয়নি। অনন্যা আগে অনেকবার কল করতো৷ ওইদিনের পর থেকে আর করেনি। আমিও না। শুনেছি অনন্যা চাকরী ছেড়ে দিয়েছে৷ সারাদিন বাসায়ই থাকে। আমাকে দেখে অনন্যা খাবার বাড়ল। আমাকে খেতে ডাকল। আমি শান্তভাবে না করে দিয়ে চলে আসি বাসা থেকে। 


অনন্যার প্রতি মায়া প্রগাঢ় ছিল। রাতের বেলা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হিয়া জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে। মুখ ফসকে অনন্যার কথা বলে ফেললাম। ব্যাস। আর কি লাগে। শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। হিয়াও একটা পিস। সারারাত ঝগড়া করতে পারে। আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলেও দোষ। ঘুম থেকে উঠিয়ে ঝগড়া করবে।


এভাবে আরো একমাস গেল। এখন আর হিয়ার আমাকে ভাললাগে না। বিদেশে পিএইচডির জন্য যাবে। আমি চাইনা ও যাক। কিন্তু ও যাবেই। এই নিয়ে ঝগড়া। প্রায়ই চলে৷ একদিন তুমুল ঝগড়ার মাঝে হিয়া বলে ফেললো, অনন্যা প্রেগন্যান্ট ছিল। তিনমাসের। হিয়া কিভাবে জানল সেটা জানতে চাপ দিতেই স্বীকার করল, অনন্যা সেদিন হিয়াকে নিজের অনাগত বাচ্চার দোহাই দিয়ে আমার জীবন থেকে সরে যেতে বলেছিল। আর সেদিনই আমি অনন্যাকে জানোয়ারের মতো মেরেছিলাম। হয়তো সেদিন নিজের বাচ্চাকেই মেরে ফেলেছিলাম।


.


নিজেকে অমানুষ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না। আমি সেদিনই হিয়ার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাসায় ফিরে এসেছিলাম। অনন্যা আগের মতো। চুপচাপ। একঘরে ঘুমায়না। পাশের রুমে ঘুমায় অনন্যা। অনন্যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত ছিলাম।


.


একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি অনন্যা তখন ঘুম থেকে ওঠেনি। নাস্তা নেই টেবিলে। বারকয়েক অনন্যার দরজায় ধাক্কা দিলেও কাজ হল না। ভাবলাম হয়তো ঘুমাচ্ছে। তাই বিরক্ত না করে হাসপাতালে চলে গেলাম। বিকালে এসে দেখি অনন্যা এখনো নিজের রুমে। দরজা ভেঙে রুমে ঢুকতেই দেখি পুরো বিছানা র'ক্তে ভেসে গেছে। অনন্যা জ্বরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সাথে সাথেই হাসপাতালে ভর্তি করি।


জানতে পারি ডেঙ্গু। সিরিয়াস স্টেজে। প্লেটিলেট শূন্যের কোঠায়। রক্তক্ষরণ চরম। আমার মারের কারনে সেদিন অনন্যার মিসক্যারেজ হওয়ার সাথে সাথে অনন্যার জরায়ু চরম ইনজুরড় হয়। তখন থেকেই অনন্যার ব্লিডিং হতো। অনন্যা ডাক্তার দেখায়নি। কোনো চিকিৎসা করায়নি নিজের৷ আর কাউকে বলেওনি নিজের এই দুরাবস্থার কথা।


ডেঙ্গু হওয়ার কারনে অনন্যার ব্লিডিং বেড়ে গেছে। আইসিইউতে অনন্যাকে নেওয়া হল। অনন্যার মুখে অক্সিজেন মাস্ক। চোখে পানি। আমি শুধু অনন্যার হাত ধরে বলেছিলাম,


- "অনন্যা প্লিজ একটা সুযোগ দাও। ছেড়ে যেওনা প্লিজ।" 


পরেরদিন ভোরবেলায় অনন্যার অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তাররা লাইফ সাপোর্টের ব্যাবস্থা করতে থাকে। আমি অনন্যার হাত ধরা ছিলাম। আমাকে শেষ একটা সুযোগ না দিয়েই অনন্যা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হতো। কিন্তু এভাবে!


আমি আমার ঘুমন্ত নিষ্পাপ অনন্যার হাত ধরে বসেছিলাম ওভাবে। বাবা এসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিল,


- "কষ্ট পেয়ো না ওর জন্য। ও ভাল থাকবে। অনেক কষ্টের পর মেয়েটা অবশেষে সুখের মুখ দেখেছে। ও ভাল থাকবে।"


.


অনন্যার দাফন শেষ করে আমি আমাদের বাসায় আসি। অনন্যার রুমে যাই। একটা ডায়েরী পাই। মোটা ডায়েরী। কিন্তু ভেতরে পেইজ নেই। লিখে লিখে হয়তো ছিড়ে ফেলেছে। শেষ কয়েকটা পেইজ আছে। এর মধ্যে একটা পেইজে আর্টসেলের দুঃখ বিলাসের কয়েকটা লাইন লেখা,


   "ও আমায় ভালবাসেনি,

       অসীম এ ভালবাসা ও বোঝেনি

    ও আমায় ভালবাসেনি,

       অতল এ ভালবাসা তলিয়ে দেখনি।"


(সমাপ্ত)...


-অণুগল্প

-ও_আমায়_ভালবাসেনি

-আরুশা_নূর


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন।