আমার প্রতি তোমার অবহেলা & অবহেলা স্ট্যাটাস

 অবহেলা কষ্টের গল্প

অবহেলা কষ্টের গল্প

আমাদের ছোট বোন বেনু একদিন হুট করে তার ব্যাগপত্র আর তার তিন বছরের ছেলে  নিয়ে চলে এলো বাড়িতে।বাবা অবাক হলেন। বললেন,' জামাই আসেনি? তাছাড়া আগে ভাগে কিছু না বলে তুই  হঠাৎ করে চলে এলি যে অতো সব জিনিস পত্র নিয়ে? সমস্যা হয়েছে কোন? ' 

বেনু রাগ দেখিয়ে বললো,' ওরা পেয়েছে টা কি? বাড়িটাকে হসপিটাল পেয়েছে? দাতব্য খানা পেয়েছে নাকি? '

বাবা বললেন,' কি হয়েছে ভেঙে বলতো সব।'

বেনু যা যা বললো তার সারমর্ম এরকম -

তার একমাত্র ননদ ইরার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্বামীর বাড়ি থেকে তাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।তারা ক্যান্সারের ব্যয় বহন করবে না।তারা ব্যয় বহন করতে অক্ষম।অপারগ। এখন এটা বহন করবে শুধুমাত্র বেনুর স্বামীই।যেহেতু সেই বেনুর একমাত্র ভাই।বাবা মাও গত হয়েছেন বহু আগেই।


বাবা সব শুনে বললেন,' তো এর সাথে তোর সম্পর্ক কি বল? তুই এসে পড়লি কেন সবকিছু নিয়ে?'

বেনু রাগ দেখিয়ে বললো,' আমি ওখানে থাকবো কেন? ও বোনের জন্য সব শেষ করে ফেলবে। ফকির হবে।আমি কি ফকিরের ঘর করবো নাকি? আমার বয়ে গেছে ওর ঘর করতে!'

বাবা বললেন,' আচ্ছা এখন হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নে। খাওয়া দাওয়া কর। রাতে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। এখন কথা বলে লাভ নাই।'

বেনুর রাগ একটু বেশিই। সে আমাদের কাউকেই ভয় পায় না। বাবাকেও না। সবার ছোট তো।আদরে আদরে বড় হয়েছে। এই জন্যই এরকম।

বেনু বললো,' বাবা, তুমি কিন্তু আমায় অনুরোধ করবে না ওখানে যেতে। সাবধান! অনুরোধ করলে তোমার উপর আমি প্রচন্ড রাগ করবো!'

বাবা মৃদু হাসলেন। বললেন,' আচ্ছা আচ্ছা। তুই যা বলবি তাই হবে রে মা।আমি কিছু বলবো না। তুই যা ভালো ভাবিস তাই কর। এখন আমার নাতিকে দে আমার কোলে। তাকে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে আসি।'

বলে বাবা বাবুকে নিয়ে চলে গেলেন মোড়ের দিকে।সারা বিকেল হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন।বাড়ি ফিরে মাগরিবের নামাজ পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করলেন। তিলাওয়াত শেষ হলে লম্বা সময় ধরে দোয়া করলেন। দোয়া শেষ হলে বেনুকে বললেন,' বেনু, চা করে আন তো মা।চা খাবো।তোর জন্যও এক কাপ আনিস। দুজন খাবো একসঙ্গে।'

বেনু গিয়ে আমার স্ত্রীকে বললো, চা করে দিতে।

আমার স্ত্রী চা করলো।চা করা হলে কাপে করে নিয়ে এলো বাবার কাছে। তখন বেনুও এসে বসলো বাবার পাশে। সে এক কাপ নিলো। বাবাকে এক কাপ দিলো। আমার স্ত্রী চা দিয়ে চলে গেল।

বাবা বললেন,' বেনু, বউটা সারাদিন খাটা খাটুনি করে।শেষে ওকে দিয়ে তুইও চা টা করালি! নিজেই করতে পারতি কষ্ট করে।'

বেনু কথায় কথায় বলে ফেললো,' ননদেরা কি সারা বছর এসে বসে থাকে নাকি?  কদিনের জন্য বেড়াতে এলে এটা ওটা রান্না করে খাওয়াবে।চা- সেমাই করে দিবে। এইগুলো কি দোষের বাবা? এইগুলো তো সাধারণ রীতি।'

বাবা হাসলেন। বললেন,' ঠিকই বলেছিস। এইগুলো সুন্দর।ভাবিরা কাজ করছে।ননদেরাও হাত লাগাচ্ছে।কাজ শেষ হলে একসাথে খাচ্ছে। আনন্দ আহ্লাদ করছে।ননদের কষ্টের সময় ভাবিরা কষ্ট পাচ্ছে।ভাবিদের কষ্টের সময় ননদেরা কষ্ট পাচ্ছে।এইগুলোই তো সৌন্দর্য।রীতি।'

বেনু কিছু বললো না। বুঝতে পারেনি আসলে বাবা কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা!

বাবা এবার বললেন,' ইরফান ফোন করেছিল সন্ধ্যার আগে।'

বেনু রাগ দেখালো।বললো,' কি বলেছে? নিশ্চয় আকুতি মিনতি করেছে যেন আমি যাই।যেন তুমি আমায় বোঝাও। এই তো? কোন লাভ হবে না বাবা।আমি যাবো না।'

বাবা খানিক শক্ত হলেন। অনেকটা ধমকের গলায় বললেন,' চুপ কর। তুই আসলে বেশিই বকবক করিস। আগে কি বলি সব শোন। তারপর কথা বল।'

বেনু দমে গেল।চুপ করে বসে রইল।মুখ দেখে মনে হচ্ছে বাবার সঙ্গে অভিমান করেছে।আদরে আদরে বড় হলে যা হয়।

বাবা বললেন,' আজ তোর ননদের এরকম হয়েছে।কাল অন্যজনের এরকম হবে। তাই না? অসুখ তো শুধু একজনের হয় না।এর, ওর অনেকেরই তো হয় । হচ্ছে তাই না?'

বেনু শুনছে। কিন্তু গাল ফুলিয়ে রেখেছে রাগে।অভিমানে। কিছু বলছে না সে নিজ থেকে।

বাবা আবার বললেন। বললেন,' আল্লাহ কখনোই এরকম না করুন। দোয়া করি। কিন্তু ধরে নে আমি বেঁচে নেই।তোর হঠাৎ বিরাট অসুখ হলো।তোর ননদের মতোই।আর তোর স্বামী তোকে চিকিৎসা করাতে নারাজি দেখালো। তখন তুই কি করবি? এখানেই তো আসবি।তাই না? '

বেনু এখনও কিছু বলছে না।চুপ করেই আছে।

বাবা তার দায়িত্ব পালন করছেন। মেয়েকে বোঝ দিতে হবে।বোঝ দিচ্ছেন।

বাবা বললেন,' ধর তুই এসে উঠলি তোর ভাইয়ের ঘরে। কিন্তু তোর ভাই তখন তোর চিকিৎসা করাতে অস্বীকার করলো। সে বললো, তোর চিকিৎসা সে করাতে পারবে না।তোর ভরণ পোষণও সে করবে না। তোর বিয়ে হয়ে গেছে এখন আর তার কোন দায় দায়িত্ব নাই তোর প্রতি।তখন তোর কেমন লাগবে? কোথায় যাবি তুই মা তখন? কার কাছে যাবি? '

বেনু বলে উঠলো,' আমার কি অধিকার নাই এখানে? ভাইয়া যেমন তোমার সন্তান , আমিও তো তোমার সন্তান।আমি কি আমার সহায় সম্পত্তি নিয়ে নিচ্ছি এখান থেকে? নিচ্ছি না ‌। তাছাড়া বোনের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব তো আছে। আমার ভাই তো কঠোর না। কৃপণ না। বোনের প্রতি তার মমতা আছে। আমার বিশ্বাস আছে, সে কোনদিন আমায় ফেলে দিবে না!'

বাবা মৃদু হেসে বললেন,' আল্লাহ তোকে অনেক জ্ঞান দিয়েছেন মা। আমি যা বুঝাতে চেয়েছি তা তুই নিজ থেকেই বুঝে নিয়েছিস। খুব ভালো।'

বেনু সম্ভবত এখনও সব বুঝতে পারেনি।বাবা যে তাকে উদাহরণ টেনে তার ননদের বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছেন তা এখনও তার মাথায় ঢুকছে না।ও এরকমই। ছোট বেলা থেকেই। কোন কিছু গিলিয়ে না দিলে ও বুঝতে পারে না।

বাবা বললেন,' তোর ননদের যে ক্যান্সার হয়েছে তাকে তোর জায়গায় কল্পনা কর তো মা। তবেই তো এর সমাধান হয়ে যায়।'

বেনু কাঁদছে।  হঠাৎ করেই ওর কান্না পেলো। বাবার সামনে বসে থেকেই কাঁদছে। কেন কাঁদছে কে জানে! কিন্তু হাউমাউ করে কাঁদছে।

বাবা তার একটা হাত ধরলেন শক্ত করে। সেই হাত দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,' কাঁদিস না মা! তুই যে বুঝতে পেরেছিস এটাই আমার বড় পাওয়া।'

বাবা বেনুর চোখ মুছে দিলেন। তারপর তাকে আরো কাছে টেনে বসিয়ে বললেন,' আর কখনোই এরকম ভুল করবি না।মন সব সময় বড় রাখবি।একটা কথা সব সময়ই মনে রাখবি। যাদের মন বড়।যারা মানুষের প্রতি উদার।যারা মানুষের জন্য খাটে।সেবা যত্ন করে।তারা কখনো ঠকে না। দুনিয়াতে তাদের এক সময় অনেক সম্মানিত করেন আল্লাহ।আর আখেরাতে তো সম্মান আছেই।

ইরফান‌ মন খারাপ করেছে তোর এই আচরণে। সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে মনে।তোর ভাবি যদি এরকম করতো তবে তোর ভাইও কষ্ট পেতো। সুতরাং, তুই আগামীকালই বাবুকে নিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে চলে যাবি ওখানে। গিয়ে ইরফানের কাছে সরি বলবি! তোর ননদকেও সরি বলবি ‌। ঠিক আছে?'

বেনু বললো,' জ্বি বাবা।আমি তাই করবো।'

বাবা তখন আমার স্ত্রীকেও ডাকলেন।ডেকে বললেন,' বেনুর ঘটনা থেকে তুমিও শিক্ষা নিবা মা।সবারই ভালো সময় এবং খারাপ সময় আসে। ভালো এবং খারাপ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।এসব কিছু মেনে নিতে হয়। ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের অনেক পছন্দ করেন।'

আমার স্ত্রী বাবাকে কথা দিলো।বললো,' বাবা, আল্লাহ যেন কখনোই আমায় সংকীর্ণ মনা না করেন।'

বাবা বললেন,' আমিন।'

আমি বাবার এই আচরণ দেখে মোহিত হলাম। আর মনে মনে বললাম, এরকম বাবা থাকলে তার সন্তানেরা কখনোই বিপথে যাবে না।গেলেও শিগগির ফিরে আসবে।বাবারাই ফিরিয়ে আনবে।

'


পরিশিষ্ট -

বেনুর ননদ এখন আর নাই । দেড় বছর অসুখের সঙ্গে লড়াই করে সে তার আপন ঠিকানায় চলে গেছে। বোনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হাতের সব ক্যাশ শেষ হয়ে গিয়েছিল ইরফানের। কিছু সম্পদও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।বেনু এতে আর মন খারাপ করেনি। সে বরং যতোটুকু পেরেছে তার ননদের সেবা করেছে। সান্তনা দিয়েছে।পাশে থেকেছে।

কয়েকবছর পর আবার তাদের সুখ ফিরে এসেছে। ইরফানের ব্যবসা ছিল। তার বোনের অসুখের সময় ব্যবসার মূলধন খরচ করে ফেলায় সেই ব্যবসাও ছিল পতনের মুখে। কিন্তু আল্লাহর কি অসীম করুণা। ইরফানের ব্যবসা এখন আরো বড় হয়েছে। আগে কর্মচারীর প্রয়োজন হতো না। এখন তিন কর্মাচারী দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারে না।টাকা পয়সা জলের মতো আসছে।সহায় সম্পত্তি বাড়ছে।

বেনুর এখন সুখ আর সুখ। বাবার কথাগুলো সে অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছে।পালনও করে সে। অসহায় কেউ তার কাছে হাত পাতলে‌ কখনোই  খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় না।গরীব অসহায় আত্মীয় স্বজনেরা সব সময় তার দ্বারেই আসে। সে যতোটুকু পারে অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করে। এখন সবাই তার প্রশংসা করে।আমি জানি, মৃত্যুর পর এই গুণের জন্য হলেও আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন।


গল্প-বেনুর_অন্য_জীবন

-অনন্য_শফিক

মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন...